পাবনার সুজানগর উপজেলার নাজিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মশিউর রহমান খানের বিরুদ্ধে এক মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিকে মাদক মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ উঠেছে। গাঁজার গাছসহ গ্রেপ্তার হালিম শেখ (৫০) নামে এক সহযোগীকে বাঁচাতে আফছার মোল্লা (৪০) নামে এক মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিকে থানায় নিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন তিনি।
চেয়ারম্যানের নির্দেশে ও ভয়ে হালিমের অপরাধ নিজের কাঁধে নিয়ে আফছার এখন কারাগারে। এ ঘটনায় এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
অভিযুক্ত হালিম শেখ নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের নওয়া গ্রামের মৃত আব্দুল মাজেদ শেখের ছেলে ও ভুক্তভোগী আফছার মোল্লা একই গ্রামের মৃত আব্দুল আজিজ মোল্লার ছেলে। উভয়ই চেয়ারম্যানের প্রতিবেশী।
মঙ্গলবার (০১ মার্চ) দুপুরে নওয়া গ্রামে গেলে এলাকাবাসী ও ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যরা জানান, গত শনিবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) ভোরে পার্শ্ববর্তী হালিম শেখের নিজ বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাকে গাঁজার গাছসহ আটক করে থানায় নিয়ে যায়। এদিন দিবাগত রাত ১২টার পর হঠাৎ আফছারের বাড়িতে এসে তাকে হালিমের সব দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে স্বীকার করে থানায় জবানবন্দি দিতে বলেন আটক হালিম শেখের ভাই বাদশা, দুই ছেলে তারেক ও নয়ন এবং চেয়ারম্যানের আরেক সহযোগী জদু সরদার।
এজন্য তাকে এক হাজার টাকাও দেন তারা। পরের দিন সকালে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে তারা আফছারকে জোর করে চেয়ারম্যানের বাড়িতে নিয়ে যান। সেখান থেকে চেয়ারম্যান ও তার সহযোগীরা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে থানায় নিয়ে যান। পুলিশের কাছে আফছার তাদের শেখানো কথা জবানবন্দি দিলে পুলিশ হালিমের সঙ্গে আফছারকেও কারাগারে প্রেরণ করে।
ভুক্তভোগী আফছার মোল্লার স্ত্রী শাহিদা খাতুন সুজানগর নিউজ বলেন, রাত ১২টার দিকে হঠাৎ হালিম শেখের ভাই ও ছেলেরা এসে আমার স্বামীকে ডাকাডাকি করেন। এ সময় আমরা ঘুম থেকে উঠলে তারা আমার স্বামীকে হালিমের দোষ স্বীকার করতে বলেন। তারা বলেন, ‘হালিমের গাঁজার গাছ তুই লাগিয়েছিস, তুই গাঁজা খাস। তুই স্বীকার করলে হালিমকে ছেড়ে দেবে আর তুই পাগল, তোর কিছু হবে না, পুলিশ তোকে ধরবে না।’ এ সময় আমার স্বামী প্রথমে এতে অস্বীকৃতি জানালে তারা তাকে চড়-থাপ্পড় মারেন এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে এক হাজার টাকা দিয়ে পরদিন সকালে তাদের সঙ্গে থানায় যাওয়ার জন্য বলে চলে যান। পরদিন সকালে আমার স্বামী মাঠে কাজে যাওয়ার পথে জোর করে তারা চেয়ারম্যানের বাড়িতে নিয়ে যান। পরে চেয়ারম্যান নিজে ও তার সহযোগীরা থানায় নিয়ে যান। পরে শুনি আমার নির্দোষ স্বামীকেও পুলিশ কারাগারে পাঠিয়েছে।
আফছারের ভাই খালেক মোল্লা সুজানগর নিউজ বলেন, আমার ভাই মানসিক ভারসাম্যহীন। মাঝে মধ্যে তাকে পায়ে শিকল ও হাতে বেড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। সে নিয়মিত পাবনা মানসিক হাসপাতালের চিকিৎসা নেয় ও ওষুধ খায়। মাঝে মধ্যে যখন সুস্থ থাকে তখন এলাকায় দিনমজুরের কাজ করে। পাশাপাশি তার বউও বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে সংসার চালায়। তারা খুব নিরীহ পরিবার। আমরা থানায় গিয়ে পুলিশকে অনুরোধ করেছি, কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। এখন আমরা তার স্ত্রী-শিশুকন্যাকে নিয়ে বড় অসহায় অবস্থায় পড়েছি।
আফছারের ১০ বছরের শিশুকন্যা সাদিয়া খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, আমার আব্বু পাগল। আব্বু সেদিন আমার সঙ্গেই ঘুমিয়ে ছিল। পরদিন সকালে আব্বুকে জোর করে কিছু মানুষ ধরে নিয়ে থানায় দিয়ে এসেছে। আমি আমার আব্বুর মুক্তি চাই।
স্থানীয় গ্রামপুলিশ ইয়াছিন আলী সুজানগর নিউজ বলেন, আমার উপস্থিতিতেই হালিম শেখকে তার নিজ বাড়িতে লাগানো গাঁজার গাছসহ আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। পরদিন শুনি চেয়ারম্যানের লোকজন আফছারকে ধরে থানায় নিয়ে গেছে। খবর পেয়ে আমি থানায় গিয়ে দেখি ইতোমধ্যেই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে।
আব্দুল মান্নান, ইনামুল হক, মিলন, খাইরুল শেখ, সাহিদা খাতুন ও রোজিনা বেগমসহ কয়েকজন এলাকাবাসী বলেন, আফছার একজন নিরীহ মানুষ এবং পাগল। আমরা পাগল হিসেবেই তাকে চিনি ও জানি। যখন রোগ বেশি হয় তখন তাকে শিকল-বেড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে দেখি। কোনো ধরনের অপরাধের সঙ্গে তাকে জড়িত হতে দেখিনি। এমন একজন মানসিক রোগীকে চেয়ারম্যান এভাবে ফাঁসিয়ে দেবেন ভাবতেও পারিনি।
আফছারকে থানায় দেওয়ার কথা স্বীকার করে নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মশিউর রহমান খান সুজানগর নিউজ বলেন, গ্রেপ্তারের পর হালিমের ভাইয়েরা আমার কাছে আসে এবং বলে- ‘তিন মাস আগে তাদের বাড়িতে আফছার ফুলের গাছ মনে করে গাঁজার গাছটি লাগিয়েছিল।’ আমি আফছারকে জিজ্ঞাসা করলে সেও গাছ লাগানোর কথা স্বীকার করে। পরে আমি ও হালিমের লোকজন তাকে নিয়ে থানার ওসির কাছে যাই। আফছার ওসির সামনে সব দোষ নিজেই স্বীকার করলে পুলিশ দুজনকেই হাজতে পাঠায়।
তিনি বলেন, যেহেতু আফছার নিজে দোষ স্বীকার করেছে, তাই হালিম যেন একটু লাভবান হয় এজন্য তাকে আমি থানায় নিয়ে গিয়েছিলাম।
আফছারকে নানা ভয়ভীতি ও লোভ দেখিয়ে থানায় জোর করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে মশিউর রহমান খান বলেন, হালিমের ভাইয়েরা একটু জোরটোর করতে পারে, কিন্তু আমি করিনি। আমার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ বানোয়াট ও মিথ্যা।
এ বিষয়ে সুজানগর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল হান্নান সুজানগর নিউজ বলেন, যেহেতু সে নিজে স্বীকার করেছে সেহেতু হালিমের সহযোগী হিসেবে তাকেও (আফছার) কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে চেয়ারম্যান নিজে আফছারকে থানায় নিয়ে যাওয়ার কথা বললেও ওসি বলেন, ঘটনাস্থল থেকেই আফছারকে আটক করা হয়েছে। পরে চেয়ারম্যানকে ডাকা হয়েছিল, চেয়ারম্যানের সামনেই সে স্বীকার গেছে। এখন চেয়ারম্যান বা কে কী বলল সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। আমার এজহারে যেটা বলা আছে সেটাই বিষয়। মামলার এজহারে ঘটনাস্থলে আটকের বিষয় উল্লেখ আছে।